অপ্রত্যাশিত পুনর্মিলন
অপ্রত্যাশিত পুনর্মিলন
শীতের এক শান্ত সন্ধ্যা। ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তা ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। অফিস থেকে বের হয়ে সায়েমের মনটা কেমন যেন অস্থির লাগছিল। জীবনের একটা সময়ে, যখন সব কিছু খুব সহজ আর সরল মনে হতো, তখনকার কথা মনে পড়ল। আজকের দিনটা তার জন্য একটু বিশেষ, কারণ ঠিক পাঁচ বছর আগে, এই দিনেই সে আর রাইমা একে অপরের জীবন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।
রাইমা ছিল সায়েমের কলেজের সহপাঠী। দু’জনের পরিচয় হয়েছিল প্রথম বর্ষের ক্লাসে। রাইমা ছিল খুব প্রাণবন্ত, আর সায়েম ছিল একটু শান্ত প্রকৃতির। তাদের একে অপরের প্রতি আকর্ষণ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। পড়ালেখার ফাঁকে একসঙ্গে সিনেমা দেখা, বইয়ের দোকানে ঘুরে বেড়ানো আর আড্ডায় মেতে থাকা—এসব তাদের জীবনের স্বাভাবিক অংশ হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু জীবনে সব সম্পর্ক সহজ হয় না। পড়াশোনা শেষ করার পর তাদের জীবনে শুরু হয় বাস্তবতার কঠিন পরীক্ষা। সায়েম চাকরি পেয়ে ঢাকায় চলে এলো, আর রাইমা পরিবারের চাপে অন্য একটি শহরে চলে গেল। দূরত্ব বাড়তে শুরু করল, আর সাথে সাথে ভুল বোঝাবুঝিও।
একদিন, তাদের মধ্যে তর্ক হলো। রাইমা অভিযোগ করল, সায়েম তার জন্য সময় দিচ্ছে না। আর সায়েম বলল, রাইমা তার কেরিয়ারকে গুরুত্ব দেয় না। সেই ঝগড়ার পর, রাইমা সম্পর্ক শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সায়েমও আর কিছু বলল না। তারা যে পথ ধরে চলছিল, তা যেন হঠাৎই আলাদা হয়ে গেল।
আজ পাঁচ বছর পর, সায়েম ভাবছিল, যদি সময়টা আবার ফিরে পাওয়া যেত। সে জানে, জীবনে অনেক কিছু বদলেছে। তার কাছে এখন একটা স্থায়ী চাকরি আছে, বন্ধু-বান্ধব আছে, কিন্তু কোনো কিছুই রাইমার শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেনি।
সায়েম যখন এইসব ভাবনায় মগ্ন, তখন হঠাৎ করেই তার ফোনটা বেজে উঠল। পরিচিত একটা নাম দেখে তার বুক ধক করে উঠল। "রাইমা?" সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। পাঁচ বছর পর রাইমা কেন তাকে ফোন করল?
ফোনটা ধরতে একটু সময় লাগল। অপর প্রান্ত থেকে এক চেনা কণ্ঠ ভেসে এলো, "হ্যালো, সায়েম। কেমন আছ?"
সায়েম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, "রাইমা! এটা কি সত্যি? তুমি হঠাৎ আমাকে ফোন করলে কেন?"
রাইমা একটু হাসল। সেই হাসিটা যেন পাঁচ বছর আগের সেই দিনগুলোর মতোই পরিচিত। সে বলল, "আমি ঢাকায় এসেছি। ভাবলাম, দেখা করলে কেমন হয়। যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে।"
সায়েমের মনে যেন ঝড় বইতে লাগল। পাঁচ বছর পর তার কাছে আসার কারণ কী? সে বলল, "ঠিক আছে। কোথায় দেখা করব?"
রাইমা বলল, "তোমার পছন্দের সেই পুরোনো কফিশপে। আজ রাত আটটায়।"
সায়েম রাজি হয়ে গেল। সারা বিকেল সে কিছুতেই কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, সময় যেন খুব ধীরে চলেছে।
অবশেষে রাত আটটা বাজল। সায়েম কফিশপে পৌঁছাল। সেখানে ঢুকে তার মনে হলো, সময় যেন থমকে গেছে। রাইমা বসে ছিল জানালার ধারে, গাঢ় নীল রঙের একটা শাড়ি পরে। সে কিছুটা বদলেছে, কিন্তু তার চোখের সেই উজ্জ্বলতা এখনও একই রকম।
রাইমা তাকে দেখে একটু হাসল। "তোমাকে দেখছি এতদিন পরেও একদম একই রকম আছ।"
সায়েম হাসল, "তুমি তো বদলে গেছ, রাইমা। কিন্তু তোমার হাসিটা এখনও আগের মতো।"
তারা বসে গল্প করতে শুরু করল। প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো যেন তাদের কাছে ফিরে এলো। রাইমা বলল, "জানো, সায়েম, আমি ভেবেছিলাম আমাদের সম্পর্কটা হয়তো ভুল ছিল। কিন্তু আজ বুঝতে পারি, আমাদের মধ্যে যে ভালোবাসা ছিল, তা সত্যিই বিশেষ কিছু।"
সায়েম একটু চুপ করে বলল, "হয়তো আমরাই ভুল করেছিলাম, রাইমা। আমাদের উচিত ছিল একে অপরকে আরও বোঝা।"
রাইমা চোখের কোণায় জল নিয়ে বলল, "তুমি ঠিক বলেছ। কিন্তু সায়েম, আমি চাই তোমার জীবনের বর্তমানটাও সুখী হোক।"
সায়েম বলল, "রাইমা, পাঁচ বছরে অনেক কিছু পেয়েছি, কিন্তু সুখ? সেটা শুধু তোমার সঙ্গেই ছিল।"
তাদের কথাগুলো যেন দু’জনের জীবনের শূন্য জায়গাগুলো পূরণ করছিল। তারা বুঝতে পারল, ভালোবাসা কখনও মুছে যায় না।
রাত গভীর হতে শুরু করল। তারা কফিশপ থেকে বের হয়ে একসঙ্গে হাঁটতে লাগল। ঠান্ডা বাতাস বইছিল, আর রাস্তার আলো তাদের পথ আলোকিত করছিল।
রাইমা হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, "সায়েম, আমি আবার আমাদের সম্পর্কটা শুরু করতে চাই। যদি তুমি চাও।"
সায়েমের চোখে যেন আনন্দের ঝিলিক দেখা দিল। সে বলল, "রাইমা, আমি তো সেই দিন থেকেই অপেক্ষা করছি, যেদিন তুমি ফিরে আসবে।"
তাদের সেই রাতে পথচলা শুধু একটি পুনর্মিলনের গল্প নয়; এটি ছিল এক নতুন শুরুর গল্প। তারা প্রতিজ্ঞা করল, জীবনের সব ভুল-ভ্রান্তি দূরে রেখে, একে অপরের পাশে থেকে সুখী হবে।
তাদের ভালোবাসা প্রমাণ করল, কিছু সম্পর্ক ভেঙে যায় না; সময় আর দূরত্ব কেবল তাদের আরও গভীর করে।