প্রিয় মানুষকে হারানোর গল্প

 প্রিয় মানুষকে হারানোর গল্প

নাহিদ এবং সারা, দুটি নাম যাদের মিলনে তৈরি হয়েছিল এক অভূতপূর্ব বন্ধন। তারা একে অপরকে ছোটবেলা থেকে জানত। গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা তাদের সম্পর্ক ছিল অদ্ভুত এবং নিখুঁত। নাহিদ ছিল সারা থেকে এক বছরের ছোট, তবে তার মনের গভীরে একটা আলাদা জায়গা ছিল সারার জন্য। সারা ছিল খুবই মিষ্টি, হাস্যময়, আর হাসির মাঝে লুকিয়ে ছিল তার দুর্বলতা। তাদের সম্পর্ক ছিল খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ, যেন তারা একে অপরের জীবনের অপরিহার্য অংশ।

প্রিয় মানুষকে হারানোর গল্প

গ্রামের ছোট স্কুলেই তারা পড়াশোনা করত। নাহিদ, যে ছিল একটু একঘেয়ে, কখনো কাউকে খুব একটা কাছে পেত না, কিন্তু সারা ছিল সবার সাথে মিশে চলা। সারা একদিন নাহিদকে ডেকে বলল, "তুমি খুব একা থাকো, নাহিদ। তোমার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগে।" নাহিদ কিছুটা অবাক হয়ে বলেছিল, "তুমি ভাবো না, সারা, আমি একা, তবে আমি জানি, তুমি আমার পাশে আছো।"

সারা তার হাসি দিয়ে নাহিদের কথা কিছুটা হাসি-রসিকতার মতো নিয়েছিল, কিন্তু ভেতর থেকে জানত, নাহিদ তার জন্য বিশেষ। সময় যত গড়িয়েছে, নাহিদ এবং সারা একে অপরের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। তবে তাদের ভালোবাসার রূপ তখনও ঠিক স্পষ্ট হয়নি, এমনকি নিজেদেরও বুঝতে পারেনি তারা।

একদিন নাহিদকে তার বাবার কাছ থেকে শোনার জন্য এসেছিল একটি অপ্রত্যাশিত সংবাদ। তার বাবা তার পরিবারকে নিয়ে শহরে চলে যেতে চাচ্ছিল। নাহিদ শুনে খুব অবাক হয়ে বলেছিল, "বাবা, তুমি তো জানো আমি শহরে যেতে চাই না। আমি এখানে থাকতে চাই, সারার সাথে, আমাদের গ্রামে।" কিন্তু নাহিদের বাবা তাতে রাজি হননি। সে বলেছিল, "তোমাকে শিখতে হবে নতুন জায়গায় বসবাস করতে, নাহিদ। শহরে জীবন অন্যরকম, তুমি যদি কিছু করতে চাও, তাহলে সেই পরিবেশে থাকতে হবে।"

সারা যখন শুনেছিল, সে নাহিদকে শান্ত করে বলেছিল, "তুমি যা বলছো, সেটা ঠিক। তবে তুমি জানো, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। যখনই তুমি ফিরে আসবে, আমি তোমার জন্য এখানে থাকব।"

কিন্তু সময়ের স্রোত কখনও থামে না, আর একসময় নাহিদ শহরে চলে গেল। প্রথম প্রথম তাদের সম্পর্ক কেবল ফোনে ও চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু একসময়, যোগাযোগ কমতে শুরু করল। নাহিদ তার নতুন জীবনে এতোটা ডুবে গিয়েছিল যে, সারা আর তার মধ্যে আগের মতো সম্পর্ক রাখার মতো সময় পায়নি। সারা অবশ্য নাহিদকে সবসময় মনে রাখত, কিন্তু তারও জীবনের পথ পাল্টাতে শুরু করেছিল।

সারা একদিন নাহিদকে ফোন করে বলেছিল, "নাহিদ, আমি জানি তুমি ব্যস্ত, কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা কি আর আগের মতো হবে না?" নাহিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, "সারা, আমি খুবই দুঃখিত। আমি জানি, আমি তোমার কাছ থেকে দূরে চলে গেছি, কিন্তু আমি তোমার জন্য এখনও একই অনুভূতি রাখি।"

তবে সারা বুঝতে পারল, নাহিদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সে এখন অন্য মানুষ হয়ে উঠেছে, অনেক নতুন বন্ধুর সাথে তার সম্পর্ক বেড়েছে। সারা নাহিদকে সেই রাতে একবার সবার কথা বলে দিল, "আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমি নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চাই। তুমি আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলে, কিন্তু আমি জানি আমাদের পথ আলাদা।"

তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেল। সারা নাহিদকে একদিকে যেমন ভালোবাসত, তেমনি তার নিজস্ব জীবন শুরু করার জন্য প্রস্তুত ছিল। সময়টা খুবই কঠিন ছিল সারা জন্য, কারণ নাহিদ তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিল। কিন্তু সারা জানত, জীবনে কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যা অমোঘভাবে আলাদা হতে হয়।

একদিন, অনেক বছর পর, সারা তার জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখে, সে বহু বছর নাহিদের কথা মনে করেছে। সারা তখন বুঝতে পারল, জীবনের যাত্রা কখনও থেমে থাকে না। মানুষের মধ্যে কখনো ভালোবাসা হারায় না, তবে কখনো কখনো সম্পর্কের পথ পাল্টে যায়।

তবে, সেই দিনটির পর থেকে সারা জানত, প্রিয় মানুষকে হারানো মানে এই নয় যে তাকে ভুলে যাওয়ার কথা। বরং, হারানো মানুষটির স্মৃতি ও সম্পর্কের শিক্ষাকে জীবনে ধারন করে পথ চলা উচিত। সারা তখন আর নাহিদকে শারীরিকভাবে কাছে না পেলেও, তার আত্মায় তিনি অমর হয়ে রইলেন।

একদিন, সারা তার পুরনো বাড়ির কাছে হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ তাকে মনে পড়ল নাহিদের কথা। সে সেই পুরানো দিনগুলো মনে করতে করতে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মনে হল, জীবন চলে গেলেও, কিছু কিছু মানুষ থাকে, যারা কোনো না কোনোভাবে একদিন ফিরে আসে, আবার তাদের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। সারা জানত, নাহিদ তার জীবনের প্রিয়তম মানুষ ছিল, আর সেই ভালোবাসা কখনোই হারাবে না।

হ্যাঁ, প্রিয় মানুষকে হারানো কখনও সহজ নয়, তবে জীবনের এক অংশ হিসেবেই সেটা থাকতে হয়। সব কিছুর পর, সারা শিখেছিল যে, কিছু ভালোবাসা কখনও মুছে যায় না, তারা হৃদয়ে অমর হয়ে থাকে, যতদিন না আমরা তাদের স্মৃতির সাথে বেঁচে থাকি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url