শেষ হয়ে হইল না শেষ
শেষ হয়ে হইল না শেষ
এটা ছিল একটি একেবারে সাধারণ দিন। ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় সবার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা, এক ধরনের তাড়াহুড়ো ছিল। মোবাইলে বাজতে থাকা সিগন্যালের শব্দ, রিকশাচালকদের হাকডাক, আর গাড়ির হর্ণ—সব কিছুই যেন একে অপরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চলছিল। কিন্তু হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য কিছু একটা বদলে গেল। এক মূহূর্তে সব কিছু থমকে দাঁড়াল, যেন সময়টাকে একটু ধরে রাখা হয়েছে।
"শেষ হয়ে হইল না শেষ: জীবনের অজানা পথে একে অপরকে খুঁজে পাওয়ার গল্প।" |
রাহুল এবং তিশা একে অপরকে জানতেন না, তবে তাদের জীবনের মাঝে একটি অদ্ভুত সমান্তরাল ছিল। দুইজনই জীবনের বাকি পথে কিছু একটা খুঁজছিলেন। তারা ভাবতে শুরু করেছিল, শেষ হওয়ার আগে তাদের জীবনে কিছু অর্থপূর্ণ ব্যাপার ঘটবে, কিছু এমন ঘটনা যা তাদের জীবনের গল্পটাকে একেবারে আলাদা করে দেবে। তারা যখন নিজেদের মানসিক অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছিল, তখনই একদিন তাদের পথ একেবারে বদলে গেল।
তিশা একদিন এক চায়ের দোকানে বসে ছিল, তার সবার পছন্দের খেজুর পিঠা খাচ্ছিল। তার মন খারাপ ছিল। বহুদিন ধরে সে নিজের সম্পর্ক নিয়ে অস্থিরতায় ভুগছিল। তার মনে হচ্ছিল, জীবন তার সাথে খেলা করছে। কিন্তু তিশার এই খোঁজাখুঁজি, কিছু একটা পাবার চেষ্টা সেই সময়ই থামলো যখন রাহুল সেই দোকানে ঢুকল।
রাহুল ছিল একজন তরুণ লেখক, যিনি অনেকদিন ধরেই সাফল্যের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার জীবনে কখনও কখনও সাফল্য আসত, কখনও হতাশা। তবে সব সময় তিনি মনে করতেন যে, জীবন শেষ হয়ে যায়নি, যতদিন কিছু করতে পারা যায়, ততদিন সেই সবকিছুই নতুন করে শুরু করা সম্ভব। তার বইয়ের বিক্রি ছিল কম, কিন্তু লেখক হিসেবে তিনি বিশ্বাস করতেন, শেষ হয়ে যাওয়ার আগে তার কিছু লিখে রেখে যেতে হবে।
তিশা যখন রাহুলকে প্রথম দেখে, তখন সে মনে করেছিল, তাকে দেখে হয়তো রাহুলের কোনো গল্পের চরিত্র মনে হতে পারে। কিন্তু রাহুল নিজেই ছিল গল্পের ভেতরে। তার চোখে যেন কিছু একটা ছিল যা তিশার মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। সে খেয়াল করল, রাহুলও একজন মানুষ, যে নিজের জীবনের পরিপূর্ণতা খুঁজছে, সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে। তিশা কিছু বলতে গিয়ে আবার চুপ হয়ে গেল। সে জানতো না, এই মুহূর্তে তার কী বলা উচিত।
তিশার চোখে আর্দ্রতা ছিল, যেন সেই দিন তার জীবনের এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য প্রস্তুত। রাহুল তাকে এক মুহূর্তের জন্য দেখে মাথা নাড়াল। "আপনি কি ভালো আছেন?"—রাহুল এ প্রশ্নটি করল যেন, এক সহযাত্রী হিসেবে মনোযোগী হয়ে। তিশা অবাক হয়ে তাকাল। জানত না, একজন অচেনা লোক এইভাবে তাকে সহানুভূতির সঙ্গে প্রশ্ন করবে। কিন্তু তার মধ্যে ছিল এক ধরনের শান্তি, এক ধরনের নিশ্চয়তা।
"হ্যাঁ," তিশা একটু হেসে বলল, "কিছু একটা ভালো লাগছে।"
রাহুল জানতো না, তবে তার এই প্রশ্ন তিশার মধ্যে এক ধরনের মন্ত্রমুগ্ধতা তৈরি করেছিল। তিশা তাকে বলল, "আমি অনেক দিন ধরে এমন কিছু খুঁজছি, যা আমাকে আবার জীবনের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু কী যে খুঁজছি, তাও জানি না।"
রাহুল চুপ করে শুনল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, "অনেক কিছুই আমাদের জীবনে এসে যায়, তবে সেটি আসার জন্য আমরা প্রস্তুত কি না, সেটি সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আমাদের যত সময় জীবনে আছে, সেটা কাজে লাগানো উচিত। যদি শেষ হয়ে যায়, তবে সেটি অবশ্যই শেষ হবে, তবে ততদিন পর্যন্ত, কিছু করতে থাকতে হবে।"
তিশা চুপ করে রাহুলের কথা শুনছিল। কিছু একটা যেন পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল তার মধ্যে। সে প্রথমবারের মতো অনুভব করেছিল যে, কিছু একটা ভালো হতে পারে। জীবন এখনও শেষ হয়নি। তার জন্য কিছু একটা এখনও বাকি ছিল।
তিশা এবং রাহুল একে অপরকে কিছু সময়ের জন্য একসাথে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা দুজনই জানত, জীবনের পথে অজানা অনেক কিছু আসবে, তবে তাদের জন্য কখনও কিছু শেষ হয়ে যাবে না। তারা সবকিছুই কল্পনা করেছিল একে অপরকে জানার, একে অপরকে সাহায্য করার এবং একে অপরকে সঠিক পথে চলার প্রেরণা দেওয়ার মাধ্যমে।
শেষ হয়ে যাওয়া, এই ভাবনাটা তাদের মধ্যে ছিল না। তারা জানত, জীবনের মাঝে যতটুকু সময় রয়েছে, তাতে তারা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের গল্পটি লিখবে। কোনো চূড়ান্ত সমাপ্তি আসবে না। পৃথিবী যেমন চলতে থাকে, তাদের গল্পও তেমনি চলতে থাকবে—শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত।