স্ত্রীর উপার্জনে স্বামীর অধিকার
স্ত্রীর উপার্জনে স্বামীর অধিকার
ইসলামে স্ত্রীর উপার্জন তার নিজস্ব অধিকার। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে, স্ত্রীর উপার্জন বা আয়ের ওপর তার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে এবং স্বামী তার উপার্জনের ওপর কোন ধরনের দাবী করতে পারেন না। স্ত্রীর উপার্জন তার নিজস্ব সম্পদ, এবং স্বামীকে এটি গ্রহণ করার অধিকার নেই, সে যদি ইচ্ছা না করে।
"স্ত্রীর উপার্জন তার অধিকার, কিন্তু স্বামী হিসেবে সঙ্গী হওয়ার মানে একে অপরের সমর্থন ও সম্মান। ভালোবাসা ও পারস্পরিক সহানুভূতির ভিত্তিতেই একটি সম্পর্ক সুন্দরভাবে বিকশিত হয়।" |
তবে, ইসলামী আইন অনুসারে, স্বামী এবং স্ত্রীর পারিবারিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কিছু নৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। ইসলাম স্বামীর উপর স্ত্রী এবং পরিবারের খরচের দায়িত্ব অর্পণ করেছে।
স্ত্রীর উপার্জন তখন স্বামী বা পরিবারের খরচের জন্য প্রয়োজন হলে স্বেচ্ছায় সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে, কিন্তু এটি স্বামীর উপর কোনো বাধ্যবাধকতা নয়। স্বামীর জন্য স্ত্রীর উপার্জন থেকে কোনো অংশ নেওয়ার অধিকার নেই, যদি না স্ত্রীর ইচ্ছা থাকে তাকে সাহায্য করার।
এই বিষয়টি রাসূল (সা.)-এর জীবনে প্রমাণিত, যেখানে তিনি কখনো স্ত্রীর উপার্জন থেকে কিছু নেননি। বরং, তিনি উম্মে সালমা (রা.) এর মত মহিলার উপার্জন এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবনকে সম্মানিত করেছেন।
ইসলামে নারীর উপার্জিত অর্থ সম্পূর্ণভাবে তার নিজস্ব মালিকানাধীন। ইসলামী পরিবারব্যবস্থা অনুসারে, স্ত্রীর উপার্জিত সম্পদের উপর স্বামীর কোনো অধিকার নেই। অর্থাৎ, স্ত্রীর অর্থ সম্পদ শুধু তার নিজের জন্য। এতে স্বামীর কোন অংশীদারিত্ব নেই বা তাকে কোনভাবে অংশগ্রহণের অধিকার দেওয়া হয় না।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট:
স্বামী-স্ত্রীর অর্থ আলাদা রাখা: সলামে স্বামী ও স্ত্রীর একে অপরের অর্থ থেকে আলাদা অ্যাকাউন্ট থাকার প্রথা রয়েছে। এটি অর্থ-সম্পদ নিয়ে ঝগড়া বা সমস্যার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় এবং দুজনের জন্য শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করে।
আলাদা অ্যাকাউন্ট থাকা মানে উভয়ের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা নয়। এটি বরং একে অপরের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো।
মোহরানা (দান হিসেবে প্রদান করা অর্থ): মহরানা স্ত্রীর হক এবং এটি তার মালিকানা। স্বামীর এটি কন্ট্রোল করার বা এটি থেকে কোন অংশ নিতে পারার কোন অধিকার নেই। অনেক সময় মহরানা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয় বা এটি নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, কিন্তু ইসলামী আইন অনুযায়ী মহরানা স্ত্রীর সম্পদ এবং তা সম্পূর্ণভাবে তার হক।
অর্থ-সম্পদ নিয়ে সঠিক মনোভাব: ইসলামী পরিবারব্যবস্থা অনুসারে, অর্থ সম্পদ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহনশীলতা এবং সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাস থাকা উচিত। একজন অপরজনের অর্থ-সম্পদ নিয়ে জোর করে কোন দাবি করার অধিকার নেই। সম্পর্কের মধ্যে স্বচ্ছতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা গুরুত্বপূর্ণ। স্বামীর উচিত স্ত্রীর স্বাধীনতা এবং তার অর্থ-সম্পদের উপর সম্মান প্রদর্শন করা।
ইসলামে, এমন একটি পরিবারব্যবস্থার গুরুত্ব রয়েছে যেখানে নারী-পুরুষের অধিকার ও দায়িত্ব অত্যন্ত পরিস্কার এবং শ্রদ্ধার সাথে পালিত হয়। এইভাবে, ধর্মীয় এবং পারিবারিক জীবনে শান্তি ও সুখ বজায় রাখা সম্ভব হয়।
এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা ইসলামী নীতির ওপর স্পষ্ট ধারণা প্রদান করে। হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, স্ত্রীর উপার্জিত সম্পত্তি পুরোপুরি তার নিজের অধিকার। স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া তার উপার্জিত অর্থ থেকে স্বামী কোনভাবেই খরচ করতে পারবেন না। তবে, স্ত্রীর নিজেই যদি তার সম্পদ থেকে সওয়াব অর্জনের উদ্দেশ্যে কিছু দান করতে চান, তা হলে তার এই দানটি দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবে, যেমন নবীজী (স.) বলেছেন।
হাদিস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ:
স্ত্রীর অর্থের মালিকানা: স্ত্রীর উপার্জিত অর্থ এবং সম্পত্তি তার নিজস্ব মালিকানাধীন। স্বামী তার অনুমতি ছাড়া সেই অর্থ থেকে কিছু গ্রহণ করতে পারেন না। এটি ইসলামের একটি মৌলিক বিধান, যা নারীকে তার ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।
দান করার সওয়াব: স্ত্রীর নিজ উপার্জিত অর্থ থেকে দান করলে তার জন্য দ্বিগুণ সওয়াব রয়েছে, একদিকে সে দান করছে, আরেকদিকে তার আত্মীয়স্বজনের প্রতি খেয়াল রেখে দান করছে। এটি ইসলামের মধ্যে নেক কাজের গুরুত্ব ও পুরস্কারের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ও দায়িত্ব: স্বামী স্ত্রীর ওপর আর্থিকভাবে যে দায়িত্ব নেন, সেটি অবশ্যই স্ত্রীর সম্মতি এবং পরিবারের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে হওয়া উচিত। যদিও স্ত্রীর সম্পদ তার নিজের, তবে স্বামী স্ত্রীকে নানাভাবে সহযোগিতা করতে পারেন, বিশেষ করে পরিবার ও শিশুদের জন্য খরচের ক্ষেত্রে।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি যা সংসারে শান্তি ও সমঝোতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। স্ত্রীর স্বাধীনতা এবং তার অর্থনৈতিক অধিকার ইসলামে অত্যন্ত সম্মানিত এবং তা পরিবারের সুখী ও সুস্থ সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
স্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে হাদিস
ইসলামে স্ত্রীর মর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা বিভিন্ন হাদিসে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে কিছু হাদিস দেওয়া হলো যা স্ত্রীর মর্যাদা ও তার সাথে সম্পর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করে:
স্ত্রীকে ভালোভাবে আচরণ করার নির্দেশনা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সেরা লোক তারা যারা তাদের স্ত্রীর প্রতি সর্বোত্তম আচরণ করে।” (তিরমিজি) এই হাদিসটি স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে যে, একজন মুসলিম পুরুষের জন্য তার স্ত্রীর প্রতি সর্বোত্তম আচরণ এবং সদ্ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, ইসলামে স্ত্রীর প্রতি সম্মান, ভালোবাসা ও যত্ন নেওয়া জরুরি।
স্ত্রী ও স্বামী সম্পর্ক: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “বিশ্বের সর্বোত্তম পুরুষ হলো সে ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর কাছে সবচেয়ে ভালো।” (বুখারি ও মুসলিম) এই হাদিসটি পুরুষদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করে, যেখানে স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা এবং সদ্ব্যবহার অত্যন্ত প্রাধান্য পেয়েছে। একটি সুখী সংসারের ভিত্তি হলো স্ত্রীর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা।
স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতি ও সহানুভূতির গুরুত্ব: রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, “তোমরা জানো, এক পুরুষের জন্য তার স্ত্রীর মতো উত্তম সহচর আর কিছুই নেই।” (আবু দাউদ)
এই হাদিসে স্ত্রীর মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তার স্ত্রীই তার জীবনের সবচেয়ে বড় এবং প্রিয় সঙ্গী। স্ত্রীর অধিকারের সম্মান: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে ভালো, তারা হলো সে ব্যক্তি যে তার পরিবার (স্ত্রী) এর সাথে ভালো আচরণ করে।” (তিরমিজি)
ইসলামি শিক্ষায়, একটি পুরুষের দায়িত্ব হচ্ছে তার স্ত্রীর অধিকার পূর্ণভাবে প্রদান করা, যেমন খাদ্য, আশ্রয়, সুরক্ষা, এবং তার মানসিক ও শারীরিক শান্তি বজায় রাখা।
স্ত্রীকে সাহায্য করা: একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবীদেরকে বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো আচরণ করবে, তার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা পুরস্কৃত করবেন।” (তিরমিজি) এই হাদিসটি স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতি এবং ভালো আচরণের জন্য পুরস্কারের আশ্বাস প্রদান করেছে।
ইসলামে স্ত্রীর মর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান রাখা প্রতিটি মুসলিম পুরুষের দায়িত্ব। স্ত্রীর প্রতি সদাচরণ, ভালোবাসা, এবং তার অধিকার নিশ্চিত করা ইসলামী জীবনব্যবস্থার মৌলিক দিক। রাসুল (সা.) এর হাদিসে এসব নির্দেশনার মাধ্যমে আমাদের প্রমাণিত হয় যে, একটি সুখী, শান্তিপূর্ণ এবং সফল সংসারের জন্য স্ত্রীর মর্যাদা বজায় রাখা অপরিহার্য।