তুমি যদি আমাকে কখনো ছেড়ে যাও

 তুমি যদি আমাকে কখনো ছেড়ে যাও

শীতের এক সন্ধ্যা। জানালার বাইরে ধীরে ধীরে ঝরে পড়ছে পাতারা। আকাশ ধূসর, আর হালকা ঠাণ্ডা বাতাস জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ছে। রুমে বসে ছিল অনির্বাণ। হাতে একটা পুরনো ডায়েরি।

তুমি যদি আমাকে কখনো ছেড়ে যাও

ডায়েরির পাতাগুলোতে ছড়ানো সাদা কালো কালি, যা কিনা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলোর সাক্ষী। প্রতিটি পৃষ্ঠার প্রতিটি শব্দ যেন একটি গল্প। তবে আজ সে একটি নির্দিষ্ট পাতায় আটকে আছে। পাতার ওপরে ছোট্ট করে লেখা— "তুমি যদি আমাকে কখনো ছেড়ে যাও।"

ডায়েরির সেই পাতার প্রতিটি শব্দ যেন তাকে সময়ের বুকে টেনে নিয়ে গেল কয়েক বছর আগে। তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে অনির্বাণ। সেদিনই প্রথম সে দেখেছিল তৃষ্ণাকে।

তৃষ্ণা—তার মতোই সাধারণ কিন্তু হৃদয়ের গভীরে লুকানো এক অসাধারণ মায়া। প্রথম দিনেই ক্লাসে ঢোকার সময় হঠাৎ করে তৃষ্ণার হাত থেকে খাতাটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। অনির্বাণ এগিয়ে গিয়ে খাতা তুলে দিল। এক মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হলো। সেই চোখের দৃষ্টি যেন অনির্বাণের হৃদয়ে অজান্তেই একটি দাগ কেটে গেল।

তৃষ্ণা হেসে বলল, “ধন্যবাদ।”
অনির্বাণ হেসে উত্তর দিল, “সবসময় পাশে আছি।”

কথাটা মজা করে বলা হলেও সেই দিন থেকেই যেন তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হলো। বন্ধুত্বের শুরু সেখান থেকেই।

প্রথম স্পর্শে ভালবাসা

ধীরে ধীরে তাদের বন্ধুত্ব বাড়তে লাগল। প্রতিদিন ক্লাসের পর অনির্বাণ আর তৃষ্ণা ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করত। কখনো গল্প হতো বই নিয়ে, কখনো সিনেমা নিয়ে। তৃষ্ণা তার জীবনের স্বপ্নের কথা শেয়ার করত, আর অনির্বাণ মন দিয়ে শুনত।

একদিন তৃষ্ণা হঠাৎ বলল, “তুমি কি কখনো ভেবেছ, কেউ যদি আমাদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠে, কিন্তু একদিন হঠাৎ করে চলে যায়, তখন কেমন লাগে?”

অনির্বাণ হাসি দিয়ে বলেছিল, “তৃষ্ণা, যদি কারো জন্য সত্যিকারের ভালবাসা থাকে, তবে সে কখনো ছেড়ে যায় না। আর যদি যায়, তবে সেটি ভালবাসা ছিল না।”

তৃষ্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর হালকা গলায় বলল, “তুমি যদি আমাকে কখনো ছেড়ে যাও, আমি হয়তো বেঁচে থাকতে পারব না।”

অনির্বাণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। এই প্রথমবার তৃষ্ণার চোখে একধরনের অদ্ভুত কষ্টের ছায়া দেখতে পেল সে। কিন্তু সেই মুহূর্তে কিছু বলেনি। শুধু একটা কথা বলল, “তৃষ্ণা, আমি যতদিন বাঁচব, ততদিন তোমার পাশে থাকব। এটা আমার প্রতিশ্রুতি।”

ভালবাসার রঙিন দিনগুলো

তাদের সম্পর্কের গভীরতা দিনে দিনে বাড়তে লাগল। অনির্বাণ বুঝতে পারল, তৃষ্ণাই তার জীবনের সেই মানুষ, যার জন্য সে সবকিছু করতে পারে। তৃষ্ণাও অনির্বাণকে ভরসা করতে শিখল। দুজনের জীবন যেন একে অপরের ছায়ায় জড়িয়ে গেল।

তাদের প্রিয় সময়গুলো কাটত নদীর ধারে। তৃষ্ণা নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে বসে থাকত, আর অনির্বাণ তার পাশে বসে থাকত। তৃষ্ণা হাসতে হাসতে বলত, “জানো, এই নদীর মতো যদি আমাদের জীবনও সবসময় বয়ে যেতে পারত, তবে কতই না ভালো হতো!”

অনির্বাণ মৃদু হেসে বলত, “আমাদের জীবন নদীর মতোই হবে। বাধা আসবে, কিন্তু আমরা একসাথে সবকিছু পার করব।”

বাধার মুখে ভালবাসা

কিন্তু ভালবাসা সবসময় মসৃণ পথে চলে না। অনির্বাণ আর তৃষ্ণার ভালবাসাও একদিন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হলো। তৃষ্ণার পরিবার কখনোই অনির্বাণকে মেনে নিতে পারেনি। তারা চেয়েছিল, তৃষ্ণা যেন একটি প্রতিষ্ঠিত পরিবারের ছেলেকে বিয়ে করে।

তৃষ্ণার মা একদিন সোজাসুজি বলল, “তৃষ্ণা, এই ছেলেটা তোমার যোগ্য নয়। ওর ভবিষ্যৎ নেই, আর আমাদের পরিবারের সম্মানের সঙ্গে এটা যায় না। তুমি তার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করো।”

তৃষ্ণা ভেঙে পড়ল। সে জানত, তার পরিবার আর অনির্বাণের মধ্যে কারো একজনকে বেছে নিতে হবে। কিন্তু তৃষ্ণার মন চাইছিল না অনির্বাণকে ছেড়ে যেতে।

তৃষ্ণা একদিন অনির্বাণকে বলল, “অনির্বাণ, আমি জানি না কী করব। আমি আমার পরিবারকেও কষ্ট দিতে চাই না, আর তোমাকেও ছেড়ে যেতে পারব না।”

অনির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তৃষ্ণা, যদি আমাকে ছেড়ে যেতে হয়, তবে যাও। কিন্তু মনে রেখো, আমি তোমাকে কখনো দোষ দেব না। কারণ ভালবাসা মানে শুধু একসাথে থাকা নয়, ভালবাসা মানে একে অপরকে সুখী দেখতে চাওয়া।”

তৃষ্ণার চোখে পানি এসে গেল। সে কিছুই বলতে পারল না।

বিচ্ছেদের বেদনাময় দিনগুলো

তৃষ্ণা একদিন সত্যিই চলে গেল। তার পরিবার তাকে অন্য একজনের সঙ্গে বিয়ে দিতে বাধ্য করল। অনির্বাণ চুপচাপ সবকিছু মেনে নিল। কিন্তু তার মন জানত, তৃষ্ণার স্মৃতি সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না।

অনির্বাণ নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখল। সে লেখালেখি শুরু করল, আর সেই লেখার মধ্যেই তৃষ্ণার স্মৃতিগুলো ধরে রাখল। তার প্রতিটি গল্পে, প্রতিটি কবিতায়, প্রতিটি শব্দে তৃষ্ণার ছায়া ছিল।

তৃষ্ণাও তার নতুন জীবনে সুখী ছিল না। সে অনুভব করত, তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল অনির্বাণকে ছেড়ে যাওয়া। কিন্তু সে কিছুই করতে পারত না।

অপ্রত্যাশিত পুনর্মিলন

কয়েক বছর পরে, একদিন হঠাৎ করে তৃষ্ণা আর অনির্বাণের দেখা হলো একটি অনুষ্ঠানে। তৃষ্ণার চোখে ছিল একধরনের অপরাধবোধ, আর অনির্বাণের চোখে ছিল একধরনের শান্তি।

তৃষ্ণা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বলল, “অনির্বাণ, তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?”

অনির্বাণ মৃদু হেসে বলল, “তোমাকে কখনোই দোষ দিইনি, তৃষ্ণা। তুমি তোমার পরিবারকে সম্মান দিতে চেয়েছ, আর সেটাই ঠিক ছিল। ভালবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়, ত্যাগ করার মধ্যেও ভালবাসা লুকিয়ে থাকে।”

তৃষ্ণা কিছু বলতে পারল না। শুধু তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

অনির্বাণ হাসি দিয়ে বলল, “তুমি যদি আমাকে ছেড়ে না যেতে, তবে হয়তো আমি নিজেকে এতটা শক্তিশালী করে তুলতে পারতাম না। তোমার জন্য আমার ভালবাসা কখনোই শেষ হবে না, কিন্তু এখন আমি এটাও বুঝতে পেরেছি—তোমার সুখের জন্যই আমি আজও তোমার পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছি।”

শেষ কথা

তৃষ্ণা আর অনির্বাণ হয়তো একসাথে জীবন কাটাতে পারেনি, কিন্তু তাদের ভালবাসা থেকে যায় চিরন্তন। জীবন কখনো কখনো আমাদের কাছ থেকে প্রিয় মানুষকে দূরে নিয়ে যায়, কিন্তু সেই ভালবাসা আমাদের হৃদয়ে থেকে যায় চিরকাল।

ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় অনির্বাণ লিখেছিল—
"তুমি যদি আমাকে কখনো ছেড়ে যাও, জানবে আমার ভালবাসা ঠিক ততটাই গভীর থাকবে। কারণ ভালবাসা মানে শুধু কাছে থাকা নয়, একে অপরের জন্য সুখ প্রার্থনা করাও।"

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url